অজীব উপাদান, যেমন- মাটি, পানি, আলো, বাতাস, জলাশয়, হাওর, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত, হিমবাহ, মরুভূমি, বায়ুমণ্ডল, বারিমণ্ডল, মেঘমালা, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদি এবং সজীব উপাদান, যেমন- উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব ইত্যাদির সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। এগুলোর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ। এ পরিবেশের মধ্যে বিরাজ করছে মানব কর্তৃক সৃষ্ট পরিবেশ, যেমন- ঘরবাড়ি, গ্রাম-শহর, সুউচ্চ ভবন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, সেতু, বাঁধ, মোটরযান, রেলওয়ে, উড়োজাহাজ, রকেট, স্টিমার, ইটভাটা, বিদ্যুৎ, শিল্পকারখানা, ইন্টারনেট, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, জাহাজ-শিল্প, অস্ত্র-কারখানা, পারমাণবিক চুল্লি ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় পরিবেশের সমন্বয়েই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এ সুন্দর পরিবেশ। একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের জন্য অজীব ও জীব প্রতিটি উপাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভৌতিক, রাসায়নিক ও জৈবিক কারণে এ উপাদানগুলোর মধ্যে যে কোনো একটির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলে সামগ্রিক পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং পরিবেশ দূষণ হয়। মানুষের অসচেতনতা এবং অনিয়ন্ত্রিত আচরণের কারণেই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে উৎপাদিত ক্ষতিকারক পদার্থ, যেমন- গ্রিন হাউস গ্যাস, ইগজোস্ট গ্যাস, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, আর্সেনিকযুক্ত বর্জ্য, পারদ, ক্যাডমিয়াম, সিসা, বালাইনাশক, আগাছানাশক, ধোঁয়া, ধোঁয়াশা, ধূলিকণা, ময়লা-আর্বজনা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করে।
বৃক্ষের ভূমিকা : খাদ্যের উৎস, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চিত্তবিনোদন এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন প্রকার ফল, মিষ্টি রস, ভেষজ দ্রব্য, কাঠখড়িসহ অনেক মূল্যবান সম্পদ পাই। বিভিন্ন প্রকার ফল উৎপাদনে বৃক্ষের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ফল শারীরিক ও মানসিক পরিপূর্ণতা বিকাশ লাভে সহায়তা করে। বিভিন্ন প্রকার কাঠের ওপর ভিত্তি করে দেশে আসবাবপত্র তৈরির বৃহৎ শিল্প, যেমন- বনজ শিল্প, হাতিল, আকিজ, নাভানা, অটোবি ইত্যাদি এবং কাঠমিস্ত্রিদের দ্বারা ক্ষুদ্র ফার্নিচার শিল্প গড়ে ওঠেছে। সমগ্র বিশ্বে বৃক্ষভিত্তিক বৃহৎ শিল্প, যেমন- কাগজ, রাবার, রেয়ন, হার্ডবোর্ড, রেশম, চা, পামঅয়েল, কোকো ইত্যাদি এবং কুটির শিল্প, যেমন- আগর, রেজিন, লাক্ষ্মা, খয়ের, মধু, বাঁশ-বেত শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটছে। তাল-খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি হয়। এ রসের ওপর ভিত্তি করে যশোর, ফরিদপুর, নাটোর, রাজশাহী অঞ্চলে গুড়ভিত্তিক গ্রামীণ শিল্পের প্রসার ঘটেছে। নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে গদি, জাজিম, পাপস, রশি, ব্রাশ, ঝাড়– এবং তাল-খেজুরের পাতা দিয়ে পাটি, থলে, বেড়া, ঘরের ছাউনি ও কাণ্ড ঘরের বর্গা-খুুঁটি তৈরিতে ব্যবহƒত হয়। শিমুলগাছের তুলা দ্বারা লেপ, তোষক, বালিশ, সুতা ইত্যাদি তৈরি হয়। বৃক্ষের ডালপালা ও পাতা জ্বালানির প্রধান উৎস। দুনিয়ার সব রোগের ওষুধ রয়েছে উদ্ভিদের মধ্যে। ভেষজ বৃক্ষের শেকড়, ছাল-বাকল, পাতা, ফুল, বীজ ও বিভিন্ন প্রকার ফল, যেমন- আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, অর্জুন, নিম ইত্যাদি আয়ুর্বেদিক/হারবাল/ইউনানি ওষুধ তৈরির প্রধান উপাদান। হেকিম ও কবিরাজরা ভেষজ ওষুধ দ্বারা সর্দি-কাশি, জ্বর, ব্যথা, হাড়ভাঙ্গা, আমাশয়, কৃমি, বাত, সাদা শ্রাব, সুতিকা, মেহ-প্রমেহ, ডায়াবেটিস, প্রেসার, জন্ডিস, পাইলস, একজিমা, দুধবাহারসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করেন। ভেষজ ওষুধ দ্বারা গবাদি-পশুরও চিকিৎসা হয়। দেশে হামদর্দ, সাধনা, শক্তি, এপি, কুণ্ডেশ্বরীসহ বহু আয়ুর্বেদিক ওষুধ শিল্প গড়ে উঠেছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকায় মানুষের এসব ওষুধের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। হারবাল প্রসাধনীর প্রধান উৎস বৃক্ষ। অনেক গাছের পাতা-ছাল-শেকড়-বীজ দ্বারা জৈব বালাইনাশক তৈরি হয়। বহু মূল্যবান ঔষধি বৃক্ষ বিলুপ্তির কারণে ভেষজ পণ্য আমদানি করতে হয়। তাই ঔষধি বৃক্ষ সংরক্ষণের জন্য সরকারি উদ্যেগ একান্ত প্রয়োজন। বৃক্ষরাজি বাতাস থেকে CO2 শোষণ এবং অক্সিজেন (O2) ত্যাগের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। একটি বয়স্ক বৃক্ষ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে। বাতাস থেকে ৬০ পাউন্ডের অধিক বিষাক্ত গ্যাস শোষণ ও ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। শত শত টন কার্বন শোষণের মাধ্যমে বায়ুর দূষণরোধ ও তাপদাহ দুপুরে প্রস্বেদনের মাধ্যমে বাতাসে প্রায় ১০০ গ্যালন পানি নির্গত করে পরিবেশ ঠা-া রাখে। বৃক্ষরাজি শব্দ দূষণও রোধ করে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি বন ১০ ডেসিবল শব্দ হ্রাস করতে পারে। সর্বোপরি সবুজ বৃক্ষের মনোরম দৃশ্য ও নির্মল বাতাস সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ সব মানুষের চিত্তবিনোদনের আকর্ষণীয় উপাদান।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে নিম্নের বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা মানব সম্প্রদায়েরই করণীয়:
১. সড়কপথ, রেলপথের দু-ধার, পাহাড়, টিলা, উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা, নদ-নদী, খাল-বিলের পাড়, বাঁধ, বেড়িবাঁধ, হাটবাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ির আশপাশে ফাঁকা জায়গায় প্রচুর পরিমাণে ফলদবৃক্ষ, যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কুল, আমড়া, জলপাই, পেয়ারা, আতা, সফেদা, কমলা, লেবু, বেল, কদবেল, ডাউয়া, করমচা, চালতা, জাম্বুরা, জামরুল, শরিফা, কামরাঙা, গোলাপজাম, তেতুল, সজনা, নারিকেল, সুপারি, তাল, খেজুর, পামঅয়েল, গোলপাতা ইত্যাদি, বনজবৃক্ষ, যেমন- সেগুন, মেহগণি, আকাশমণি, কড়ই, রেইনট্রি, বাবলা, গর্জন, শাল, চিকরাশি, শিশু, গামার, জারুল, দেবদারু, শিমুল, বট, পাকুর, খয়ের, হিজল, তরুল, চন্দন, কদম, ঘোড়ানিম, ছাতিয়ান ইত্যাদি ভেষজবৃক্ষ, যেমন- আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, অর্জুন, জাতনিম, নিশিন্দা, বাসক, শতমূল, অ্যালোভেরা, নয়নতারা, কালমেঘ, সর্পগন্ধা ইত্যাদি ও মসলাজাতীয় বৃক্ষ, যেমন- তেজপাতা, দারচিনি, গোলমরিচ, জায়ফল, আলুবোখারা, কাজুবাদাম, কাঠবাদাম ইত্যাদি রোপণ করে বাগান ও সামাজিক বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে।
২. নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ এবং বৃক্ষ কর্তনের ওপর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। অবাধে পাহাড় কাটা, নদী ভরাট এবং বালু উত্তোলন রোধ ও আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে।
৩. কাঠের ফার্নিচারের বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিক, লোহা ও স্টিলের তৈরি ফার্নিচার ব্যবহার করতে হবে। খড়ির বিকল্প হিসেবে চারকোল, গ্যাস, কয়লা ও ঘুটের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। উন্নত চুলায় কম ধোঁয়া নির্গমন ও অল্প খড়ির প্রয়োজন হয়। তাই এ চুলার ব্যবহার সম্প্রসারণ করতে হবে।
৪. যানবাহনে সীসামুক্ত জ্বালানি ও সিএনজি ব্যবহার করতে হবে। শিল্পকারখানা এবং ইটভাটার চিমনি অনেক উঁচু করে তৈরি ও ধোঁয়া নির্গমণ হ্রাস করতে হবে। বিষাক্ত বর্জ্য ও ক্ষতিকারক গ্যাস নির্গমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসাবে পাটজাত ও অন্যান্য পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করতে হবে। দূষণরোধে পলিথিন, প্লাস্টিক ও ইলেকট্রনিক বর্জ্য রিসাইক্লিনিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে।
৫. শিল্পকারখানার বর্জ্য খাল, বিল ও নদীতে না ফেলে ইটিপি স্থাপনের মাধ্যমে শোধন করতে হবে। বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে ডাস্টবিনের ময়লা-আর্বজনা এবং জৈব বর্জ্য দ্বারা বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ ও জৈব সার উৎপাদন করতে হবে। বায়োটেকনোলজি প্রযুক্তির সাহায্যে সুপার ফানশনাল ব্যাকটেরিয়া উৎপাদন করে বর্জ্য বা আবর্জনাকে দ্রুত পচনশীল করার মাধ্যমে সার্বিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
৬. উপকূলীয় অঞ্চলের বাঁধ, বেড়িবাঁধ, স্লুইস গেট এবং অন্যান্য স্থাপনাগুলো মজবুত করে তৈরি করতে হবে যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। লবণাক্ত পানি সহজে নিষ্কাশনের জন্য এক মিটার গভীর করে ড্রেন ও সাব ড্রেন তৈরি করতে হবে। জলাশয় তৈরি করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যেন এ পানি শুষ্ক মৌসুমে ফসলের জমিতে ব্যবহার করা যায়। ৭. কৃষি গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার ফসলের শীত, তাপ, বন্যা ও লবণসহিষ্ণু নতুন জাত উদ্ভাবন এবং বালাইনাশক ও আগাছানাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।